অজানা লিঙ্ক, আচমকা ভিডিয়ো কল, এসবেই লুকিয়ে আছে প্রতারণার ফাঁদ, কী ভাবে বাঁচবেন?
ফোনে তথ্য জেনে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার কায়দা নতুন নয়। এবার শুরু হয়েছে লিঙ্কের খেলা। একটা ক্লিকের দূরত্বেই অপেক্ষা করছে বিপদ। জেনে বুঝে পা না ফেললেই সব শেষ হয়ে বেশি সময় লাগবে না। ছোট্ট ভুলেই পুরো স্মার্টফোনটা এক নিমেষে চলে যেতে পারে হ্যাকারদের হাতে। এমন ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে। একটা নয়, একাধিক উপায়ে চলছে প্রতারণা।
লোন- অ্যাপের মাধ্যমে প্রতারণা:
অনেকের কাছেই ইনস্ট্যান্ট লোন বা তাৎক্ষণিক ঋণ দেওয়ার লোভ দেখিয়ে মেসেজ আসে। ওই মেসেজের মধ্যে থাকে একটি লিঙ্ক। যারা ঋণ নিতে আগ্রহী বলে ওই লিঙ্কে ক্লিক করছেন, তাঁদের মোবাইলে একটি অ্যাপ ইন্সটল হয়ে যাচ্ছে। যখন অ্যাপ ইন্সটল হচ্ছে তখন অজান্তেই মোবাইলের সমস্ত কনট্যাক্ট লিস্টে থাকা ফোন নম্বর চলে যাচ্ছে ওই অ্যাপের জালিয়াতদের কাছে। এরপর যদি আপনি ৫০০০ টাকা ঋণ নিতে চান, সে ক্ষেত্রে আপনি হাতে পাবেন ৪২০০ টাকা। ৮০০ টাকা সুদ বাবদ প্রথমেই কেটে নেওয়া হবে। ধরা যাক, এক মাসের মধ্যে টাকা শোধ করতে বলল। আপনি টাকা শোধ করতে শুরু করলেও দিন ১৫ পর থেকেই আপনাকে ফোন করে চাপ দিতে থাকবে।
টাকা শোধ হয়ে গেলেও ফোনের ওপার থেকে বলতেই থাকবে যে আপনি টাকা শোধ করেননি। এই ভাবে চাপ দিয়ে দিয়ে দ্বিগুণ টাকা নিয়ে নেবে। যদি আপনি পাল্টা চাপ দেন যে টাকা শোধ করে দিয়েছেন, তখন জালিয়াতদের কাছে চলে যাওয়া কন্টাক্ট লিস্টের মানুষদের কাছে ফোন বা মেসেজ যেতে থাকবে। তাঁদের গ্যারান্টার রাখা হয়েছে বলে দ্বিতীয় ব্যক্তিকেই টাকা শোধ করার জন্য আবার চাপ দেওয়া হবে।
কীভাবে বাঁচবেন?
এ ক্ষেত্রে মানুষের সচেতনতাই বাঁচার একমাত্র উপায়। গোয়েন্দারা বলছেন, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার অনুমোদন ছাড়া কোনও ব্যাঙ্ক বা মাইক্রো ফিনান্স কোম্পানি ঋণ দেয় না। এই জায়গাতেই প্রথমে সর্তক হতে হবে। দ্বিতীয় হল, গুগল প্লে স্টোরের বাইরে থেকে কোনও অ্যাপ ইন্সটল করবেন না। প্লে স্টোরে যেহেতু এই ধরনের জালিয়াতির কারবার করা যায় না, তাই এরা বাইরে থেকে অ্যাপ ইন্সটল করার লিঙ্ক পাঠায়। সুতরাং বাইরে থেকে আসা এই ধরনের লিঙ্কে কোনও ভাবেই ক্লিক করবেন না।
ভরতপুর গ্যাং:
রাজস্থানের ভরতপুর থেকে এই গ্যাং-টি চালানো হয়। এটি পুলিশমহলে ভরতপুর গ্যাং বলেই পরিচিত। এ ক্ষেত্রে জালিয়াতরা ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রামে সুন্দরী মহিলার ছবি দিয়ে প্রথমে ফেক প্রোফাইল তৈরি করে। তারপর সেই প্রোফাইল দিয়ে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায়। ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট গ্রহণ করলেই শুরু হয় মেসেঞ্জারে চ্যাট করা। চ্যাটের মাধ্যমে প্রথমে বন্ধুত্ব করে। সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হতে শুরু করলে হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর চেয়ে নেয়। হোয়াটসঅ্যাপে চ্যাট করে আরও ঘনিষ্ঠ হয়। প্রশ্রয় দিলেই শুরু করে সেক্স চ্যাট।
তারপর আচমকাই কোনও একসময় হোয়াটসঅ্যাপে ভিডিয়ো কল করে। রিসিভ করলেই দেখা যায় ফোনের ওপারে নগ্ন মহিলা বসে রয়েছে। গোয়েন্দারা বলছেন, কথা বলার বাহানায় আসলে ফোনের অপর প্রান্তে চালিয়ে দেওয়া হয় পর্নোগ্রাফিক ভিডিয়ো। এমনভাবেই ভিডিয়ো দেখানো হয় যেন ওই সুন্দরী মহিলা মোবাইল ক্যামেরার সামনে এসেছে। কল রিসিভ করলেই জালিয়াতরা স্ক্রিন রেকর্ড করে নেয়। তাতে মনে হবে যেন জেনেশুনেই ভিডিয়ো কলে সেক্স চ্যাট করা হয়েছে। এরপর স্ক্রিন রেকর্ড করা ভিডিয়ো ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে শুরু হয় ব্ল্যাকমেলিং, টাকা চাওয়া। টাকা দিতে শুরু করলে টাকার অঙ্ক বাড়তে থাকে। এই ভাবেই বহু মানুষকে জালিয়াতির শিকার বানিয়েছে ভরতপুর গ্যাং।
কীভাবে বাঁচবেন?
এই জালিয়াতির শিকার থেকে বাঁচতে গেলে অচেনা কারও ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট গ্রহণ না করার পরামর্শ দিচ্ছেন গোয়েন্দাদের। একইসঙ্গে আচমকা কোনও অজানা নম্বর থেকে যদি ভিডিয়ো কল করা হয় তাহলে সেটা কেটে দিয়ে নম্বর ব্লক করার পরামর্শ দিচ্ছেন গোয়েন্দারা।
জামতারা গ্যাং:
ঝাড়খণ্ডের জামতারা থেকে এই গ্যাংটি চালানো হয়। এই গ্যাংটি প্রথমে ব্যাঙ্ক কর্মী বলে পরিচয় দিয়ে মানুষকে ফোন করত। কখনও বলা হত, ব্যাঙ্কের ডেবিট কার্ড এক্সপায়ার হয়ে যাবে, কখনও আবার অ্যাকাউন্ট বন্ধ হয়ে যাবে বলা হত। নানা অছিলায় ব্যাঙ্কের তথ্য নিয়ে পাঠাত ওটিপি। মানুষকে বোকা বানিয়ে ওটিপি নিয়েই অ্যাকাউন্ট ফাঁকা করে দিত নিমেষে। বর্তমানে তারা আরও আধুনিক ও ডিজিটাল পদ্ধতিতে জালিয়াতি করছে।
নতুন পদ্ধতির নাম ইউপিআই ফ্রড। কখনও পেটিএম-এর কেওয়াইসি করার নামে, কখনও সিম কার্ড-এর কেওয়াইসি আপডেট করার নামে, কখনও ফুড ডেলিভারি সংস্থার কাস্টমার কেয়ারের নাম করে জালিয়াতির ফাঁদ পাতে জামতারা গ্যাং। এখন তারা ভ্যাকসিনের বুস্টার ডোজ দেওয়ার নাম করে নয়া কায়দায় জালিয়াতি শুরু করেছে। এই পদ্ধতিগুলোর মাধ্যমে মানুষকে তাদের ফাঁদে ফেলে। কখনও রেজিস্ট্রেশন করার নামে, কখনও বা ফুড ডেলিভারি সংস্থার টাকা রিফান্ড করার নামে মোবাইলে এসএমএসের মাধ্যমে লিঙ্ক পাঠায় জালিয়াতরা।
ভুলবশত সেই লিঙ্কে ক্লিক করলেই আপনার মোবাইলের কন্ট্রোল চলে যায় জালিয়াতদের হাতে। তারপর আপনার মোবাইলের তথ্য হাতিয়ে নেয় তারা। রেজিস্ট্রেশনের নামে তাদের দেওয়া লিঙ্কের মাধ্যমে টাকা পাঠাতে গেলেই আপনার মোবাইলের পাসওয়ার্ড দেখে নেবে জালিয়াতরা। তারপরেই সাফ করবে আপনার অ্যাকাউন্ট।
কীভাবে বাঁচবেন?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন জামতারা গ্যাং-এর ফাঁদ থেকে বাঁচতে গেলে কোনও অজানা নম্বর থেকে আসা এই লিঙ্কে ক্লিক করবেন না। ক্লিক করলেই বিপদ কারণ। ওই লিঙ্কটি আসলে আপনার মোবাইল হ্যাক করার রাস্তা।
ক্রিপ্টোকারেন্সি ফ্রড:
এটাও এক ধরনের ডিজিটাল চিটফান্ড। এ ক্ষেত্রেও একসঙ্গে বহু মানুষের কাছে মেসেজ পাঠাচ্ছে জালিয়াতরা। বলা হচ্ছে ক্রিপ্টোকারেন্সিতে বিনিয়োগ করলে অল্পসময়ের মধ্যেই টাকা দ্বিগুণ হয়ে যাবে। ফাঁদে পা দিলেই তাদের এজেন্ট বলছে যে তারা বিদেশে যেখানে ক্রিপ্টোকারেন্সি বৈধ সেখানে টাকা বিনিয়োগ করে অর্থাৎ এক ধরনের ক্রিপ্টোকারেন্সি এক্সচেঞ্জ তারা চালাচ্ছে। ফাঁদে পা দিয়ে মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে টাকা বিনিয়োগ করলেই অল্প ক’দিনের মধ্যেই অ্যাপের ড্যাশবোর্ডে দেখাবে টাকা দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছে। সেই লোভে আরও কিছু বিনিয়োগ করলে তখনও টাকা দ্বিগুণ হচ্ছে বলে দেখাতে থাকবে। এভাবে ধাপে ধাপে যখন বিনিয়োগের অঙ্ক লক্ষধিক টাকা ছাড়াবে তখনই আচমকা যোগাযোগ বন্ধ করে দেবে ওই এজেন্টরা। ইতিমধ্যেই বহু মানুষ এই ফাঁদে পা দিয়ে কয়েক লক্ষ টাকা খুইয়েছেন।